দক্ষিণ এশিয়ায় তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) খাতে সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ। শ্রমঘন দেশটিতে গার্মেন্ট শিল্পের পরই সম্ভাবনাময় খাত আইটি। একদিকে দেশীয় বাজারে আইটিখাতের বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। অপরদিকে রফতানিখাতেও নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এসব বিষয় সামনে রেখে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করেছে সরকার।
আইটিখাতে বিনিয়োগকারীদের ১০ বছরের কর অব্যাহতি সুবিধা ঘোষণা করা হয়েছে। সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোতে বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে ১০ দিনের রোড শোর সমাপনী অনুষ্ঠানে দেশি-বিদেশি অংশীজনদের বক্তব্যে এ সব বিষয় উঠে আসে। রোড শোর মূল বিষয় ছিল ‘রাইজ অব বেঙ্গল টাইগার : পটেনশিয়াল ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট।’
সানফ্রান্সিসকোর সান্তা ক্লারার হায়াত রিজেন্সিতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকে বক্তব্য দেন দেশটির ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের মেয়র লিসা এম গিলমোর। বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব আবদুর রউফ তালুকদার, বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ, বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম, রফতানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বেপজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল নজরুল ইসলাম, বিএসইসির কমিশনার ড. মিজানুর রহমান এবং প্রধানমন্ত্রীর ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের সদস্য ও ভেঞ্চার ক্যাপিটাল অ্যান্ড প্রাইভেট ইক্যুইটিজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শামীম আহসান। অনুষ্ঠানে পেগাসাস টেক ভেঞ্চারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আনিসুজ্জামান এবং স্টার্ট আপ বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক টিনা জাবিনসহ বেশ কয়েকজন দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তা বক্তব্য দেন।
লিসা এম গিলমোর বলেন, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও তথ্যপ্রযুক্তিখাতে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে নারীর ক্ষমতায় ও অর্থনৈতিক বিভিন্নখাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। এ অবস্থায় এ রোড শো দুই দেশের সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করবে।
সালমান এফ রহমান বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন উৎপাদনশীল কোম্পানি, ব্যাংক, বীমা, মিডিয়া এবং বিদ্যুৎখাতে নেতৃত্ব দিচ্ছে বেসরকারিখাত। অর্থমন্ত্রীসহ বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ব্যবসায়ীদের মধ্য থেকে নেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বের কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে। এ অগ্রযাত্রায় বিনিয়োগ চাই। তিনি বলেন, প্রবাসীদের বিনিয়োগে এগিয়ে আসা উচিত। আর প্রবাসীদের সব ধরনের জটিলতা কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমরা ডিজিটাল অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।
প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান পরিবেশ বিনিয়োগবান্ধব। বিশেষ করে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক সক্ষমতা, মানুষের ক্রয় ক্ষমতা, মুদ্রার বিনিময় হার, যুব শ্রমশক্তি এবং ইকো সিস্টেম সবকিছুই বিনিয়োগ উপযোগী। তিনি বলেন, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল এবং স্টার্টআপ বিজনেসের সম্ভাবনা বাড়ছে। বিশেষ করে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের গ্রাহক দ্রুত গতিতে বাড়ছে। এ অবস্থায় বিনিয়োগের এখনই উপযুক্ত সময়। তিনি আরও বলেন, বিনিয়োগকারীদের সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে বাংলাদেশ। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক দিক থেকে বিশ্বের প্রথম অবস্থানে যুক্তরাষ্ট্র। সে কারণে রফতানিতে বিভিন্ন দেশে উচ্চ শুল্ক দিতে হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ এক্ষেত্রে সুবিধা পাচ্ছে। বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে বিনিয়োগ করলে চীন, ভারত, ইউরোপ ও জাপানের বাজার থেকে শুল্কমুক্ত সুবিধা নিতে পারবে। তিনি বলেন, এক বছরে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি হয়েছে। আলোচ্য সময়ে এ খাতে বেশ কিছু সংস্কার হয়েছে। আর এসব সংস্কারের সুফলও মিলছে।
সিরাজুল ইসলাম বলেন, আইটিভিত্তিক স্টার্টআপকে সহায়তা দিচ্ছে সরকার। এবারের বাজেটেও বিভিন্ন সহায়তার কথা বলা হয়েছে। ২৯টি হাইটেক পার্কের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এসব পার্কে ইউটিলিটি সুবিধা সবচেয়ে বেশি।
মিজানুর রহমান বলেন, প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। করোনাভাইরাসের ক্ষতি মোকাবিলায় বেশ কিছু পদক্ষেপ ঘোষণা করেছে সরকার। এগুলো বাস্তবায়নে কাজ চলছে। সবকিছু মিলে বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশে আর্কষণীয় পরিবেশ রয়েছে।
অনুষ্ঠানে অন্য বক্তারা জানান, বাংলাদেশে আইটিখাতের সম্ভাবনা বাড়ছে। আইটির ব্যবহারও বাড়ছে। বর্তমানে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৭ কোটি ৬০ লাখ। বিশেষ করে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের আওতা দ্রুতগতিতে বাড়ছে। এছাড়া ভেঞ্চার ক্যাপিটাল এবং স্টার্টআপ বিজনেসের মতো আইটিনির্ভর খাতের দ্রুত সম্প্রসারণ হচ্ছে। এ কারণে সরকার হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক তৈরি করেছে। এ খাতে ব্যাপক সংখ্যক যুব উদ্যোক্তা এগিয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা রয়েছে।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে তুলে ধরতে গিয়ে বিভিন্ন প্রবন্ধে জানানো হয়, বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুসারে ২০৫০ সালে বিশ্বের ২৩তম অর্থনীতির দেশ হবে বাংলাদেশ। সংস্থাটির তথ্য অনুসারে দক্ষিণ এশিয়ায় দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ হলো বাংলাদেশ। একই পূর্বাভাস দিয়েছে আরেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হংকং সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশন (এইচএসবিসি)। দশ বছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ। আর মোট জিডিপিতে শিল্পখাতের অবদান ৩১ শতাংশ। প্রবৃদ্ধিকে সাপোর্ট দিতে ২০২০ সালে বাংলাদেশের অবকাঠামোখাতে ৪০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে। ২০১১ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ৮৬০ মার্কিন ডলার। বর্তমানে তা ২ হাজার ২২৭ ডলারে উন্নীত হয়েছে। এছাড়াও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। করোনার মধ্যেও ২০২০ সালে প্রবাসী আয়ে (রেমিট্যান্স) ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পূর্বাভাস অনুসারে করোনার মধ্যে ২৩টি দেশ অর্থনৈতিকভাবে ইতিবাচক অবস্থানে থাকবে। সংস্থাটি বলছে, এরমধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এছাড়া বর্তমানে বাংলাদেশে মোট শ্রমশক্তি ৭ কোটি। এরমধ্যে সাড়ে ৫ কোটিই বয়সে তরুণ। ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি অত্যন্ত সম্ভাবনাময়।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের অর্থনীতির সম্ভাবনা তুলে ধরে বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগ আর্কষণে যুক্তরাষ্ট্রের চারটি গুরুত্বপূর্ণ শহরে ১০ দিনের রোড শোর আয়োজন করা হয়। এরমধ্যে রয়েছে- নিউইর্য়ক, ওয়াশিংটন ও লসএঞ্জেলেসে বাংলাদেশের আর্থিকখাতের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হয়। সোমবার সমাপনী দিনে আইটিখাতের সম্ভাবনা তুলে ধরা হয়। শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এ আয়োজন করে। অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বে সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশকে তুলে ধরে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করা হলো এ আয়োজনের উদ্দেশ্য। বিশেষ করে প্রবাসী বাংলাদেশিরা যাতে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে সে বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানে বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকেও সাড়া মিলছে।